Just another Dude.
ভর্তি পরীক্ষার পরে, ক্লাস শুরু হবার আগের সময়টায়, পোলাপানরা সাধারনত সদ্য গজিয়ে উঠা গোফটায় বার বার ক্ষুর চালিয়ে, সেটাকে তা দেয়ার জন্য উপযোগী করে তোলে। আমি ভাবলাম ক্ষুর না চালিয়ে বা এলাকায় পুরান টিউশনি খান আবার চালু না করে, ঢাকায় গিয়ে নতুন টিউশনি খুজতে পারি। অনেক টাকা দেয় শুনছিলাম। যেই কথা সেই কাজ, ঢাকায় এসে টিউশনি খুজতে থাকি। কয়েকটা টিউশনি মিডিয়াতে ট্রাই করেও কোন লাভ হয় না। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা মিলিয়ে আয়তনে কম হওয়ায়, বদনখানি দেখেই ডাইরেক্ট না করে দিছিলো এক গার্ডিয়ান। কয়েকদিন না যেতেই, আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে নিছক ভুল বুঝাবুঝি থেকে আমাকে অভিযুক্ত করা হলো। নিজেকে নিঃদোষ প্রমান করতে ব্যর্থ হয়ে, কাউকে কিছু না জেনেই, পরেরদিন ভোরে জিনিসপত্র যা ছিলো সব নিয়ে, ঐ বাসা থেকে বের হয়ে যাই। এখন, কোটি মানুষের ঢাকা শহরে এই আমি থাকমু কোথায়?
মগবাজার গেলাম, কলেজের এক ফ্রেন্ডের, নাম ছিলো, পিচ্চি সেলিম (উচ্চতা কম বলে, এমন নাম)। কিন্তু তার ওখানে রাখতে পারবে না। আরো দুইজনের কাছে ট্রাই করেও লাভ হলো না। এলাকার এক আঙ্কেল চা খাইয়ে বিদেয় করে দিছিলো। সারাদিন পার করে, শেষমেষ, গ্রিন রোডে, IBA হোস্টেলের উল্টা পাশে, কাজিপাড়ায়, কাজির একটা বিশাল মেস ছিলো। সেই মেসের সামনে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের সাথে কথা বলে, ডাবলিং করে থাকার ব্যবস্থা করি। সে ফার্মগেটে একটা চশমার দোকানে কাজ করতো, আর আমাকে তার আত্নীয় পরিচয়ে থাকতে হবে। সেদিন কেনো যে, সে আমাকে বিশ্বাস করে ছিলো, আল্লাহ মালুম। খাবারের ব্যবস্থাও সে করে দিলো। ঐখানে সিস্টেম ছিলো, কাজের বুয়ারা ৮-১০ জনের একটা গ্রুপের জন্য একসাথে রান্না করতো এবং প্রত্যেক গ্রুপের রান্না থেকে, প্রতিবেলায় বুয়া নিজের জন্য খাবার পাইতো। সে এই রকম ৬/৭ গ্রুপের রান্না করতো এবং এক গ্রুপের খাবার সে নিজে খেয়ে বাকি খাবার বিক্রি করে দিতো। আমি ছিলাম সেই খাবারের কাস্টমার। সপ্তাহখানেক এইভাবে থেকেও টিউশনি যোগাড় করতে ব্যর্থ হই। পকেট মামা ইহকাল ত্যাগ করে করে অবস্থা। এখন কি করবো? গ্রামের বাড়িতে ফেরৎ যাবো?
মাথায় অন্য একটা আইডিয়া আসলো। চলে গেলাম টঙ্গীতে, আমার খালুর হার্ডওয়ার দোকানে। টঙ্গী মার্কেটের পিছনে, নোয়াখালী পট্টিতে। সেখানে তালা-চাবি, বালতি, ঝাড়ু, কনস্ট্রাকশনের জিনিস, যা যা আছে সব বিক্রি করতাম। হাত দিয়ে তারকাটা (nail), ১ কেজি বা ২ কেজির প্যাকটে ঢুকাতে গেলে, আঙ্গুলের নখের নিচে তারকাটার খোচা লেগে, একটু একটু চামড়া উঠে যেতো। পরে পানি লাগলে জ্বলতো। আলকাতরা, কেজি করে বিক্রি করতে গেলে, মাঝারি সাইজের ড্রাম থেকে থেকে ছোট ছোট মাটির পাতিলে ঢালা লাগতো। পরিমানে ঠিক না হলে কয়েকবার কম-বেশী করে এডজাস্ট করা লাগতো এবং প্রায়ই নেকড়া দিয়ে মুছতে গেলে হাতে লেগে যেতো। যতই সাবান দিয়ে ধুয়া হোক না কেনো, খাবারের সময় ঠিকই আলকাতরার গন্ধ টের পাওয়া যেতো। আর চটের লম্বা কার্পেট গজ হিসেবে বিক্রি করলে, মাপার জন্য নিয়ে যেতাম পাশের এতিমখানার ছাদে। চটের বস্তার পশমে ভরে যেতো পুরো শরীর।
সাধারনত শুক্রবারে বড় কাস্টমার আসতো। দোকানের সামনে তাদের ভ্যানগাড়ি দাড়ানো থাকতো। এক দেড়শো আইটেমের লিস্ট আগে থেকে ওরা বানিয়ে আনতো। আমাদের দোকানে না থাকলে অন্য দোকান থেকে এনে দিতাম। একটা একটা করে মেপে ওদের ভ্যানগাড়িতে উঠাতে হতো। এইসব করতে করতে অনেক সময় সন্ধ্যা হয়ে যেতো এবং সন্ধ্যার পরই আমাদের লাঞ্চ হতো। আর মাঝে মধ্যে, কাস্টমারের জন্য আনা সিঙ্গারা-চা বেচে গেলে আমরা খাইতাম।
অনেক সময় খালু গর্ব সহকারে লোকজনের সাথে গ্বল্প করতো, "ও বুয়েটে চান্স পাইছে"। আমার মনে হয় না, আমার দিকে তাকিয়ে কেউ বিশ্বাস করতো। আবার অতি উৎসাহি কেউ কেউ, বুয়েটের ভিসির নাম জিগ্গেস করতো এবং আমি উত্তর দিতে ব্যর্থ হতাম। তারা আরো বড় সন্দেহের চোখে তাকাতো। আবার কেউ কেউ চামে বলে দিতো, তার পাশের বাসার বাড়িওয়ালার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে বুয়েটে পড়ে।
২০০২ সালে, ২১ শে ফেব্রুয়ারির কাছাকাছি সময়ে ছিলো কুরবানির ঈদ। দেশের বাড়িতে ঈদ করতে আসার পর আর টঙ্গীতে ফিরিনি। গ্রামে, আমার এক মামার মোবাইল ফোনের নতুন দোকান। কারো ফোন আসলে, সেই মোবাইল তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতাম। বকেয়া টাকা উঠাতাম। এসব চলে এপ্রিলের আগ পর্যন্ত।